সুন্দরবনের পাড় ঘেঁষা সাতক্ষীরার শ্যামনগরে এক নতুন সম্ভাবনার নাম সফটশেল কাঁকড়া। সুন্দরবনের ছায়াতলে জন্ম নেওয়া এ নরম খোসার কাঁকড়া এখন এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। চিংড়ি নির্ভরতা কমে গিয়ে বিকল্প আয়ের উৎস হিসেবে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এই চাষাবাদ।
ভোর থেকেই খামারগুলোতে ব্যস্ত সময় কাটান স্থানীয় শ্রমিকরা, নারীরা মাছ কেটে কাঁকড়ার খাবার তৈরি করেন, আর পুরুষরা খাঁচায় ছাড়েন কাঁকড়া। প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ জন শ্রমিক কাজ করেন এসব খামারে। ফলে উপকূলীয় জনপদে গড়ে উঠছে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ।
শ্যামনগর উপজেলার কলবাড়ি গ্রামের সেলিম হোসেন এক সময় ছিলেন নদীনির্ভর জেলে। প্রতিদিন সুন্দরবনের খাল আর আশপাশের নদীতে কাঁকড়া ধরে চলত তার সংসার। কিন্তু অনিশ্চিত আয়ের কারণে পরিবার নিয়ে ছিলেন দারিদ্র্যের ঘেরাটোপে। সময়ের সঙ্গে পাল্টে গেছে তার জীবন। এখন তিনি সফল সফটশেল কাঁকড়া চাষি। জেলে থেকে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার এই রূপান্তরের গল্প আজ এলাকার অনেকের অনুপ্রেরণা।
সেলিম হোসেন বলেন, আগে প্রতিদিন নদীতে কাঁকড়া ধরেই সংসার চালাতে হতো। এখন নিজের খামারে কাজ দিচ্ছি স্থানীয় ছেলেদের। এই চাষই বদলে দিয়েছে আমার ভাগ্য। তার খামারে কাজ করছেন বেশ কয়েকজন স্থানীয় যুবক। ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি এলাকায় নতুন উদ্যোক্তা হওয়ার আগ্রহও বাড়ছে।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে শ্যামনগরে ৩৬৪ জন চাষি প্রায় ৩২১ হেক্টর জমিতে সফটশেল কাঁকড়া চাষ করছেন। বছরে উৎপাদন হচ্ছে ৩ হাজার ৬০০ টন কাঁকড়া, যার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্য ৬০০ কোটি টাকা। গত বছর সফটশেল কাঁকড়া রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৮ লাখ ২২ হাজার মার্কিন ডলার। আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে সাতক্ষীরার এই কাঁকড়া।
স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্দুল্লাহ আল কায়ূম আবু বলেন, বিদেশি ক্রেতাদের কাছে সাতক্ষীরার কাঁকড়ার মান খুব ভালো। আমরা চাহিদা মেটাতে পারলে আরও বেশি রপ্তানি করা সম্ভব। একসময় চিংড়িই ছিল সাতক্ষীরার অর্থনীতির মূল ভরসা। তবে বিশ্ববাজারে চাহিদা কমে গেলে বিকল্প খুঁজতে শুরু হয়। ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো প্লাস্টিকের খাঁচায় সফটশেল কাঁকড়া চাষ শুরু হয়। এখন সেটিই রূপ নিয়েছে একটি সমৃদ্ধ শিল্পে।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জিএম সেলিম কালকেলাকে বলেন, দেশে-বিদেশে সফটশেল কাঁকড়ার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। যদি স্থানীয়ভাবে হ্যাচারি স্থাপন করা যায়, তাহলে এই শিল্প আরও বড় পরিসরে সম্প্রসারিত হবে এবং বৈদেশিক আয়ও বহুগুণে বাড়বে।
তিনি বলেন, শ্যামনগর উপজেলার মাত্র দুটি ইউনিয়নেই রয়েছে ৩৬৫টি বাণিজ্যিক খামার। বছরে উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ২ হাজার টন কাঁকড়া, আর কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে প্রায় ১০ হাজার মানুষের।
উপকূলীয় শ্যামনগরের মানুষের জীবনে এখন নতুন আলো ছড়াচ্ছে এই শিল্প। সফটশেল কাঁকড়া চাষ বদলে দিচ্ছে উপকূলের অর্থনীতি, স্বাবলম্বী করছে পরিবার, আর বৈদেশিক আয়ের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে পুরো অঞ্চলকে।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ লুৎফর রহমান হীরা
হেড অফিসঃ ১/ জি,আদর্শ ছায়ানীড়, রিংরোড, শ্যামলী, আদাবর ঢাকা - ১২০৭।
স্বত্ব © ২০২৫ চলনবিলের সময়