
রমজান সামনে রেখে ‘ছোলা’ ও ‘মটর’ নিয়ে দেশের বাজারে যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে, তার কেন্দ্রে রয়েছে অসাধু সিন্ডিকেট, এলসি-সংক্রান্ত জটিলতা এবং আন্তর্জাতিক বাজার সম্পর্কে ব্যবসায়ীদের অজ্ঞতা। মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য পবিত্র রমজান শুধু ইবাদতের সময় নয়, বরং খাদ্যপণ্য বিশেষ করে ছোলা ও মটরের চাহিদাও এই সময়ে বহুগুণে বেড়ে যায়। ফলে এই দুটি পণ্য ঘিরেই ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা যেমন দেখা যায়, তেমনি বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির অপচেষ্টাও চলে।
ছোলার আমদানি নির্ভরতা এবং দাম নির্ধারণে আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে বাজারে ছোলার কেজি ৮০ টাকার ওপরে, মণপ্রতি যা প্রায় ৩ হাজার টাকা। অথচ আন্তর্জাতিক বুকিং রেট অনুযায়ী ছোলার কস্টিং রেট পড়ছে কেজিপ্রতি মাত্র ৬৬ টাকা, মণপ্রতি সর্বোচ্চ ২ হাজার ৫৫০ টাকা। ফলে স্থানীয় বাজারে ৪০০-৫০০ টাকা মুনাফা করে তা বিক্রি হচ্ছে। এই পার্থক্য শুধু বাজার পরিস্থিতির নয়, বরং অসাধু ব্যবসায়ীদের মনগড়া ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) মূল্য নির্ধারণ ও খোঁজখবর না রাখা নতুন আমদানিকারকদের প্রতারণার শিকার হওয়ার ফল।
একজন খাতুনগঞ্জ ব্যবসায়ীর ভাষ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ৪০-৫০ শতাংশ বুকিং ফল্ট করেছে, অর্থাৎ এলসি করা হয়নি। কারণ, বাজারে পুরোনো উচ্চমূল্যের ছোলা বিক্রি হচ্ছে। যদি আন্তর্জাতিক বাজারের বর্তমান দর অনুযায়ী পণ্য আমদানি করা হয়, তবে ছোলার দাম নেমে আসবে ৭০-৭২ টাকায়, যা গত বছর রমজানে ১০০-১১০ টাকা ছিল।
মটরের বাজারেও এক ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে আগে মটরের দাম ছিল টনে ৪০০-৪৮০ ডলার, এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩০০ ডলারে। ফলে স্থানীয় বাজারে কেজিপ্রতি মটরের দাম নেমে এসেছে ৪০-৪৩ টাকায়, যা গত বছর ছিল ৬৫-৭০ টাকা। নতুন বুকিং অনুযায়ী, মটরের দাম ৪০ টাকা কেজিতে বাজারে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সব পণ্যের দাম কমে যাওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী এখনই এলসি করা শুরু করেছেন। তিনি সতর্ক করেন, কিছু ব্যবসায়ী এখনো বেশি দামে ডিও স্লিপ বিক্রি করে প্রতারণা করছেন। এতে অনেক খুচরা ব্যবসায়ী না জেনেই উচ্চমূল্যে পণ্য কিনে ক্ষতির মুখে পড়ছেন।
ভোক্তাদের স্বার্থরক্ষায় সক্রিয় কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, বাজার তদারকির জন্য শুধু খুচরা পর্যায়ে অভিযান চালালেই চলবে না। বরং এলসি রেট, আন্তর্জাতিক প্রাইস, আমদানি খরচ, বুকিং রেটসহ সব তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর ও কাস্টমস থেকে সংগ্রহ করে যাচাই-বাছাই করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ছোলা ও মটরের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমলেও আমাদের বাজারে এখনো সেই দাম কমেনি। কারণ, অনেক ব্যবসায়ী আন্তর্জাতিক বাজার সম্পর্কে অবহিত নন বা ইচ্ছাকৃতভাবে জানলেও সিন্ডিকেটের চাপের কারণে মূল্য কমাচ্ছেন না।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. শরীফ উদ্দিন জানান, বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে এবং জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ছোলা ও মটরের বর্তমান বাজার পরিস্থিতি থেকে বোঝা যায়, সময়মতো এবং সঠিকভাবে প্রশাসনিক নজরদারি এবং তথ্যভিত্তিক তদারকি না করলে রমজান সামনে রেখে আবারও সাধারণ মানুষকে চড়া দামে খাদ্যপণ্য কিনতে হবে।