ঐতিহ্যের শাঁখা শিল্প এখন হুমকির মুখে

: চলনবিলের সময়
প্রকাশ: ২ মাস আগে

13

বাংলার সমাজ-সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে শাঁখা। সনাতন ধর্মাবলম্বী নারীদের কাছে এটি শুধু অলঙ্কার নয়, বরং এক গভীর ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার। বিয়ের সাতপাকে বাঁধা থেকে শুরু করে স্বামীর মঙ্গলকামনায় বিবাহিত নারীরা হাতে শাঁখা পরিধান করে আসছেন যুগ যুগ ধরে। বিয়ের পর নারীর হাতে শাঁখা না থাকা অনেকের কাছেই অচিন্তনীয় এক বিষয়। তাই এই প্রয়োজন পূরণ করতে প্রাচীনকাল থেকেই গড়ে উঠেছে শাঁখা শিল্প।

পাবনার চাটমোহর উপজেলার হান্ডিয়াল ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম ডেফলচরা এ শিল্পের অন্যতম কেন্দ্র। পৌর সদরের নতুন বাজার থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই গ্রামটি আজও বংশপরম্পরায় শাঁখা তৈরির কাজ ধরে রেখেছে। বর্তমানে গ্রামটিতে রয়েছে ৩৭টি শাঁখারি পরিবার। এর মধ্যে প্রায় ৩০টি পরিবার এখনো শাঁখা তৈরির সাথে যুক্ত, যদিও অনেকে অভাব-অনটনের কারণে পেশা পরিবর্তন করেছেন।

শাঁখা তৈরির কষ্টসাধ্য প্রক্রিয়া

ডেফলচরার শাঁখারিরা কাঁটা শঙ্খ থেকে শাঁখা তৈরি করেন। ভারত থেকে কাটা শঙ্খ আনা হয় এবং দেশে এনে ইলেকট্রিক মোটরের সাহায্যে ফিনিশিং করা হয়। এজন্য মোটর মালিককে জোড়া প্রতি ২০ টাকা করে দিতে হয়। ফিনিশিং শেষ হলে গ্রামীণ নারী শ্রমিকেরা হাতে নকশা খোদাই করেন। নকশার ধরন ও গুণমান অনুযায়ী একটি জোড়া শাঁখার দাম ৫০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়।

তবে কাঁচামালের দাম গত ১০-১৫ বছরে বেড়ে গেছে ৪ থেকে ৫ গুণ। এর ফলে ক্রেতারা আগের মতো সহজে শাঁখা কিনতে পারছেন না, আর উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় শাঁখারিরা লোকসানের মুখে পড়ছেন।

শাঁখারিদের সংগ্রামের গল্প

এই গ্রামের শাঁখারি বিকাশ কুমার ধরের স্ত্রী সীমা রানী ধর (৩৫) বলেন—
“সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর আমার বিয়ে হয়। বিয়ের আগে বাবার কাছেই শাঁখায় নকশার কাজ শিখেছিলাম। এখন শ্বশুরবাড়িতে এসেও প্রতিদিন সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ঘরের কাজ সামলে শাঁখায় নকশা করি। প্রতিদিন চিকন শাঁখা ৩০ জোড়া আর মোটা শাঁখা হলে প্রায় ২৫ জোড়া তৈরি করতে পারি।”

অন্যদিকে শাঁখারি বাবলু কুমার ধর বলেন—
“আমাদের বাপ-দাদার পেশা শাঁখা তৈরি। ভারত থেকে শঙ্খ কেটে আনা হয়। আমরা শুধু ফিনিশিং ও নকশার কাজ করি। পরে বিভিন্ন জেলায় যেমন পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, বগুড়া প্রভৃতিতে ফেরি করে বিক্রি করি। কিন্তু কাঁচামালের দাম এত বেড়ে গেছে যে সংসার চালানোই কষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে। না হলে অনেক আগেই এ পেশা ছেড়ে দিতাম।”

শাঁখারি মধুসূদন সেন জানান—
“একসময় নিজের জন্য শাঁখা বানিয়ে বিক্রি করতাম। কিন্তু এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে কিস্তির চাপে পড়ে টাকার অভাবে ব্যবসা ছাড়তে হয়েছে। এখন মহাজনের শাঁখা ফিনিশিং করে দেই। আমাদের পূর্বপুরুষেরা এ শিল্পের সাথে যুক্ত ছিলেন, তাই ভালোবাসার টানে পুরোপুরি ছাড়তে পারি নাই।”

দিশেহারা শাঁখারিরা

শাঁখা শিল্পের মূল সমস্যাই হলো কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ও সহজ ঋণের অভাব। সরকারি বা বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। বাধ্য হয়ে অনেক শাঁখারি এনজিও থেকে ঋণ নেন। কিন্তু উচ্চ সুদ ও সাপ্তাহিক কিস্তির চাপে শেষ পর্যন্ত তারা ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন।

অন্যদিকে অভাবের কারণে অনেক সময় মহাজনের কাছে কম দামে শাঁখা বিক্রি করে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসা ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি আজ বিলুপ্তির মুখে।

সরকারি সহযোগিতা ছাড়া টিকবে না ঐতিহ্য

চাটমোহর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুসা নাসের চৌধুরী বলেন—
“এ ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হবে।”

তবে শাঁখা শিল্পে নিয়োজিত পরিবারগুলো বলছে—
“বাপ-দাদার পেশা বলে খেয়ে না খেয়ে এখনো টিকে আছি। কিন্তু আর বেশি দিন সম্ভব না। নতুন প্রজন্মকে এই শিল্পে টানতে পারছি না। সরকারি সহযোগিতা ও সহজ শর্তে ঋণ না পেলে এ শিল্প খুব শিগগিরই হারিয়ে যাবে।”

অবশেষে বলা যায়, ডেফলচরার শাঁখারিরা শত কষ্ট-অভাবের মধ্যেও বাপ-দাদার পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছেন। তাদের এই সংগ্রাম আসলে একটি ঐতিহ্যকে রক্ষা করার সংগ্রাম। কিন্তু সরকারি সহায়তা না পেলে অচিরেই হারিয়ে যাবে শাঁখা তৈরির এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প।