
- কাঁচামালের দাম ও উৎপাদন খরচ বেশি, পুঁজিরও প্রকট অভাব রয়েছে।
- আয় কমে যাওয়ায় পূর্বপূরুষদের পেশায় আসছে না নতুন প্রজন্ম।
বড় পাইকারেরা কাপড় কিনে নিয়ে কলকাতায় বিক্রি করতেন।
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে বিভিন্নজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, কাঁচামালের দাম ও প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারায় তেঘরিয়া গ্রামের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে। এর পেছনে মোটাদাগে তিনটি বড় কারণ উল্লেখ করেন তাঁরা। প্রথমত, সুতা, রং, রাসায়নিকসহ কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি। দ্বিতীয়ত, পাওয়ারলুম বা যন্ত্রচালিত তাঁতে তৈরি কাপড়ের তুলনায় হ্যান্ডলুম তথা হস্তচালিত তাঁতে কাপড়ের উৎপাদন ব্যয় বেশি পড়ে এবং তৃতীয়ত, হ্যান্ডলুম থেকে পাওয়ারলুমে রূপান্তরের মতো পুঁজি হ্যান্ডলুমের মালিক বা কারিগরদের হাতে নেই।
সব মিলিয়ে হ্যান্ডলুমে উৎপাদিত বস্ত্র এখন বাজারে টিকতে পারছে না। সে জন্য শত শত বছরের ঐতিহ্য ধরে রাখার এই পেশায় নতুন প্রজন্ম আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এর মধ্যেও কারিগর ও উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ অবশ্য তাঁতশিল্পের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে সরকারের কাছ থেকে জরুরি উদ্যোগ আশা করেন।
কয়েক হাজার থেকে এখন মাত্র ৭০টি তাঁত
যশোর জেলা তাঁত বোর্ড ও মমিননগর শিল্প সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেড সূত্রে জানা গেছে, একসময় যশোর অঞ্চলের প্রায় ঘরে ঘরেই ছিল হস্তচালিত তাঁত। ৫০ বছর আগেও এই অঞ্চলে কয়েক হাজার চরকা বা তাঁত ছিল। এখন তা কমে মাত্র ৭০টিতে নেমে এসেছে।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবেই এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন তাঁতশিল্প–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁদের দাবি, কারিগরদের প্রশিক্ষণ দিয়ে পাওয়ারলুম স্থাপনে সহায়তা ও স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া জরুরি।

রঘুরামপুরে চলছে আধুনিক তাঁত
জেলা তাঁত বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে যশোরে ২১টি পাওয়ারলুম রয়েছে। সদর উপজেলার রঘুরামপুর গ্রামে পাঁচটি পাওয়ারলুমের মধ্যে তিনটি এখনো সচল। ফলে একই পরিবারের তিন ভাই মাসুদ রানা, মতিয়ার রহমান ও ফিরোজ রানা তাঁদের বাপ–দাদার পেশা ধরে রেখেছেন।
সম্প্রতি রঘুরামপুরে গিয়ে দেখা যায়, ফিরোজ রানা পাওয়ারলুমে তোয়ালে বুনছেন। তিনি বলেন, ‘আমি যশোর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের টেক্সটাইল বিভাগ থেকে পড়েছি। চাকরিতে না গিয়ে বাবার ঐতিহ্যবাহী পেশাতেই যুক্ত হয়েছি। এই ব্যবসা আরও ভালোভাবে গড়ে তুলতে চাই।’
ফিরোজ জানান, একটি পাওয়ারলুমে প্রতিদিন ১৮-২০টি তোয়ালে তৈরি হয়। ১৩৫ টাকা দরে মমিননগর শিল্প সমবায় ইউনিয়ন সেই তোয়ালে কিনে নেয়। ফলে বিক্রির চিন্তা করতে হয় না।
এক গ্রামে ৪০০ তাঁত এখন ইতিহাস
রঘুরামপুরের পাশের তেঘরিয়া গ্রাম একসময় তাঁতশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। সেখানে অন্তত ৪০০ পরিবারের তাঁত ছিল। এখন কেবল জামশেদ আলীর পরিবার পেশাটি ধরে রেখেছে। তাঁর বাড়ির উঠানে একচালা ঘরে চারটি হ্যান্ডলুম বসানো। সেখানে কয়েকজন কারিগর গামছা বোনেন। জামশেদ আলী বলেন, ‘আমি ৫০ বছর ধরে তাঁতের লুঙ্গি-গামছা বুনছি। আমার বাবা বাবর আলীও প্রায় ৫০ বছর এই কাজ করেছেন। দাদা ওয়াসেল বিশ্বাসও তাঁতি ছিলেন। এখন আমার ছেলেরা এই পেশায় আসতে চায় না। শ্রমের তুলনায় আয় কম হওয়ায় সবাই তাঁত ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছে।’
‘সুতা নলি করার মতো দক্ষ কারিগরও এখন প্রায় শেষ,’ বলেন জামশেদ। এখন বয়স্ক দুজন মানুষই এই কাজ জানেন। তাঁরা চলে গেলে এই পেশাও বন্ধ হয়ে যাবে।

বস্ত্র বুননের ঐতিহ্য
যশোর অঞ্চলে তাঁত ও বস্ত্রশিল্পের ইতিহাস অনেক পুরোনো। ঢাকার আহমদ পাবলিশিং হাউস থেকে প্রকাশিত মোহাম্মদ মহিবউল্লাহ ছিদ্দিকী সম্পাদিত ‘জসরের ইতিহাস প্রসঙ্গ’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ আছে, যশোর শহর থেকে ১৮ মাইল দক্ষিণে কেশবপুরের মধ্যকূল গ্রামে প্রতি শুক্রবার কাপড়ের বিশাল পাইকারি হাট বসত।
অনেক আগে মধ্যকূল গ্রামে হাটবারের দিন প্রায় ৫০ হাজার টাকার দেশি তাঁতের কাপড় বিক্রি হতো। বড় পাইকারেরা সেসব কাপড় নিয়ে কলকাতার হাওড়া বা চেতলার হাটে বিক্রি করতেন। সুতা আনা হতো কলকাতা থেকে। সে সময় গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরেই চরকা বা তাঁত ছিল। নারীরাই ছিলেন এই শিল্পের চালিকা শক্তি।
বিক্রয়কেন্দ্র ও কারিগরদের দাবি
যশোরের তাঁতিদের উৎপাদিত গামছা ও তোয়ালে বিক্রির জন্য মমিননগর শিল্প সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেডের সাতটি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে যশোর সদরে পাঁচটি এবং অভয়নগর ও নড়াইলে একটি করে। তাঁতিদের কাছ থেকে কাপড় কিনে নিয়ে এসব কেন্দ্রে বিক্রি করা হয়।
ইউনিয়নের সভাপতি লোকমান হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নিজেও হ্যান্ডলুমে লুঙ্গি বুনতাম। দিনে তিনটা লুঙ্গি বানিয়ে আয় হতো মাত্র ২৪০ টাকা। এত কম আয়ে টিকে থাকা সম্ভব নয়। এখন তাঁতশিল্প বাঁচাতে হলে আমাদের পাওয়ারলুম স্থাপন করতে হবে। কিন্তু কারিগরদের হাতে সেই পুঁজি নেই।’
লোকমান হোসেন জানান, ২০ বছর আগেও যশোর জেলায় কয়েক হাজার তাঁত ছিল। এই পেশায় লাখো মানুষ যুক্ত ছিল, যা এখন কথার কথা। ‘সরকার প্রণোদনা বা সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করলে নতুন উদ্যোক্তারা আসবেন,’ বলেন লোকমান হোসেন।
সরকারের উদ্যোগ
যশোর জেলা তাঁত বোর্ডের লিয়াজোঁ কর্মকর্তা আম্বিয়া আক্তার বলেন, ‘তাঁতশিল্প রক্ষায় আমরা বহুমাত্রিক উদ্যোগ নিয়েছি। কাঁচামাল-রং, সুতা ও রাসায়নিক সহজলভ্য করার কাজ করছি। এগুলো কখনো বিনা মূল্যে, কখনো স্বল্প মূল্যে কারিগরদের সরবরাহ করা হচ্ছে। পাশাপাশি হ্যান্ডলুমের কারিগরদের পাওয়ারলুমের প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে, যাতে তাঁরা নতুন উদ্যোক্তা হতে বা কারিগর হিসেবে কাজ করতে পারেন।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ লুৎফর রহমান হীরা
হেড অফিসঃ ১/ জি,আদর্শ ছায়ানীড়, রিংরোড, শ্যামলী, আদাবর ঢাকা - ১২০৭।
স্বত্ব © ২০২৫ চলনবিলের সময়