২৪ আগস্ট ২০২৫ ইং ছিল চলনবিলের ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সমাজসেবক ও লেখক অধ্যক্ষ এম. এ. হামিদের ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৬ সালের এই দিনে ৭৬ বছর বয়সে তিনি তার জন্মস্থান নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজীপুর গ্রামে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। চলনবিলের এই কিংবদন্তি মানুষটির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি ও তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো তাঁর কর্মবহুল জীবনের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।

জন্ম ও বংশপরিচয়
১৯৩০ সালের ১ মার্চ নাটোর জেলার গুরুদাসপুর উপজেলার চলনবিল বিধৌত খুবজীপুর গ্রামে এম. এ. হামিদের জন্ম। তাঁর পিতা ছিলেন আলহাজ্ব দবিরউদ্দিন সরদার, একজন দানশীল ব্যবসায়ী; মাতা ডালিমজান। দাদা ছিলেন জহির উদ্দিন এবং নানা লাল মণ্ডল।
শিক্ষাজীবন
চলনবিলের এই মেধাবী শিক্ষার্থীর প্রাথমিক শিক্ষা যোগেন্দ্রনগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরে গুরুদাসপুর জিসিএমই স্কুলে পড়াশোনা শেষে চাঁচকৈড় নাজিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৫ সালে মেট্রিক পাস করেন। রাজশাহী গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে এইচএসসি এবং ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিএসসি পরীক্ষায় ডিস্টিংশনসহ প্রথম স্থান অর্জন করেন। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে এমএসসি সম্পন্ন করেন।
বিবাহ ও সংসারজীবন
পঞ্চম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে পারিবারিক সিদ্ধান্তে তাঁর বিয়ে হয় আলহাজ্ব মতি সরদারের কন্যা কুলছুম বেগমের সাথে। সকলের ধারণা ছিল পড়াশোনায় বাধা আসবে, কিন্তু তিনি সেই ধারণা ভুল প্রমাণ করেন। আট কন্যার জনক হলেও তাঁর কোনো পুত্রসন্তান ছিল না।

কর্মজীবন
শিক্ষকতা জীবন শুরু হয় ১৯৫৩ সালে কলাতিয়া হাইস্কুল থেকে। এরপর সাতক্ষীরা কলেজ, গাইবান্ধা কলেজ, রংপুর কারমাইকেল কলেজ, পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ, যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজ, মহীপুর হাজী মহসীন কলেজ, বগুড়া আজিজুল হক কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি বগুড়া সরকারি মুজিবুর রহমান মহিলা কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৮৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
সাহিত্যকর্ম ও সাংবাদিকতা
এম. এ. হামিদ ছিলেন একজন সুসাহিত্যিকও। তিনি ২৬টি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য— জ্ঞানের মশাল, কর্মবীর সেরাজুল হক, চলনবিলের ইতিকথা, আমাদের গ্রাম, চলনবিলের লোকসাহিত্য, বঙ্গাব্দ সমাচার, ইসলামের ছায়াতলে প্রভৃতি।
বাংলা সনের তারিখ নির্দিষ্টকরণে তাঁর অবদান অনন্য। ১৯৫৯ সালে তিনি বাংলা একাডেমিতে মাসের দিনসংখ্যা নির্ধারণের প্রস্তাব দেন, যা ১৯৮৮ সালে সরকারি অনুমোদন পায়। বর্তমানে ক্যালেন্ডার, পঞ্জিকা ও তারিখ নির্ধারণে তাঁর প্রণীত নীতিমালা অনুসৃত হচ্ছে।
এছাড়া তিনি মাসিক আমাদের দেশ পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন এবং আরও বেশ কিছু সাহিত্য ও সাংবাদিকতার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
সমাজকর্ম
শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়নে এম. এ. হামিদের অবদান অপরিসীম। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন—
খুবজীপুর মোজাম্মেল হক কলেজ (১৯৮৭)
বিলচলন শহীদ শামসুজ্জোহা কলেজ
নাটোর নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা কলেজ
খুবজীপুর হাইস্কুল, পোস্ট অফিস, মাদ্রাসা, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মসজিদ, যাদুঘরসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান।
এছাড়া এলাকার রাস্তা-ঘাট, সেতু-কালভার্ট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
পুরস্কার, খেতাব ও সনদ লাভ: মনীষী এম. এ. হামিদের যথার্থ মূল্যায়ন না হলেও তিনি এ পর্যন্ত অনেক পুরস্কার, সনদ ও খেতাব লাভ করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-
১. ‘প্রাইড অব পারফরমেন্স’ (১৯৭৬খ্রি.) জয়পুরহাট ‘হিলফুল ফুজুল’ সংস্থা হতে আদর্শ শিক্ষক হিসেবে।
২. গবেষণা ও সমাজসেবামূলক কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৬৪ সালে তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এম. এ. হামিদকে ‘তমঘায়ে খেদমত (টি.কে.)’ খেতাব ও স্বর্ণপদক দিয়েছিলেন; কিন্তু ১৯৬৯ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের রিডার ড. শামসুজ্জোহার হত্যার প্রতিবাদে তিনি টি. কে. খেতাব বর্জন করেন।
৩. বরেন্দ্র একাডেমী, রাজশাহী (০১-০২এপ্রিল, ১৯৮৩খ্রি.) হতে সাহিত্য সেবার স্বীকৃতিস্বরূপ সংবর্ধনা ও সনদ লাভ।
৪. ‘গবেষণা বিশারদ’ (১১-০২-১৩৮৭ বঙ্গাব্দ) সিরাজগঞ্জ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ হতে গবেষণামূলক ইতিহাস রচনার জন্য।
৫. ‘পল্লীরত্ন’ (২৭-১১-১৯৯২খ্রি.) পাবনা জেলা সাহিত্য পরিষদ হতে।
৬. বগুড়ার ‘সাপ্তাহিক জীবন’ পত্রিকার সাহিত্যিক গোষ্ঠী প্রদত্ত ‘জীবন সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১খ্রি.)।
৭. সাহিত্য অঙ্গনে অবদানের জন্য ‘উত্তরণ পুরস্কার ও সংবর্ধনা (১৯৯৪খ্রি.) উত্তরণ লাইব্রেরী, কাশীনাথপুর, পাবনা হতো।
৮. ‘সিরাজী পুরস্কার’ (১৯৯৪খ্রি:) সিরাজগঞ্জ কবিতা ক্লাব হতে।
৯. ‘কবি বন্দে আলী পুরস্কার’ (১৯৯৬খ্রি.) বাংলাদেশ কবিতা ক্লাব, পাবনা জেলা শাখা কর্তৃক
প্রদত্ত।
১০. ‘ভিক্টোরিয়া সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৯খ্রি.) নাটোর ভিক্টোরিয়া পাবলিক লাইব্রেরী কর্তৃক
প্রদত্ত।
১১. সাহিত্য সেবার স্বীকৃতি স্বরূপ সংবর্ধনা, পদক ও সনদলাভ (২৭-৯-১৯৮১খ্রি.)। বগুড়া বারোয়ারী সাহিত্য আসর’ কর্তৃক প্রদত্ত।
১২. ‘বিদ্যাভূষণ’ (১৭-১১-১৯৮০খ্রি.) যমুনা সাহিত্য সংস্থা, সিরাজগঞ্জ হতে প্রদত্ত।
মৃত্যুকালঃ
অতিরিক্ত কর্মব্যস্ততায় শেষ বয়সে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন হুইলচেয়ারে জীবনযাপন করেন। অবশেষে ২০০৬ সালের ২৪ আগস্ট চলনবিলের এই কিংবদন্তি মানুষটি চিরবিদায় নেন। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি স্বপ্নের চলনবিল গড়ার কাজে নিবেদিত ছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল— একদিন চলনবিল জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।
চলনবিল আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে অধ্যক্ষ এম. এ. হামিদের প্রতি, যিনি শিক্ষা, সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে রেখে গেছেন অবিস্মরণীয় অবদান।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ লুৎফর রহমান হীরা
হেড অফিসঃ ১/ জি,আদর্শ ছায়ানীড়, রিংরোড, শ্যামলী, আদাবর ঢাকা - ১২০৭।
স্বত্ব © ২০২৫ চলনবিলের সময়