চলনবিলের প্রত্যন্ত গ্রামে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে পংখারুয়া বিদ্যালয়

: উল্লাপাড়া উপজেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২ মাস আগে

12

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার চলনবিল অধ্যুষিত প্রত্যন্ত গ্রাম পংখারুয়া। চারদিকে বিল আর বর্ষায় সীমাহীন জলরাশি—যোগাযোগের একমাত্র ভরসা ছিল নৌকা। শুষ্ক মৌসুমেও চলতে হয় ভাঙাচোরা সড়ক দিয়ে। এই দুরূহ পরিবেশের মাঝেই শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে পংখারুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, যা এখন এলাকার মানুষের আশার প্রতীক হয়ে উঠেছে।

বিদ্যালয়টির যাত্রা শুরু হয় ১৯৬৮ সালে। আলহাজ ময়ান উদ্দিন জমি দান করে প্রথমে ছনের ঘরে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেন। শুরুর দিকে ছাত্রছাত্রী ভর্তি করতে শিক্ষকদের বাড়ি বাড়ি যেতে হতো। বর্ষায় অনেক শিশু ছোট ডিঙি নৌকা, কলার ভেলা কিংবা ভাসমান পাতিলে চড়ে স্কুলে আসত। সেই সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় বিদ্যালয়টি আজ আধুনিক শিক্ষার অনন্য দৃষ্টান্ত।

বর্তমানে এখানে রয়েছে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, আইসিটি ব্যবহার, সততা স্টোর, নিয়মিত অ্যাসেম্বলি, ক্রীড়া, শরীরচর্চা, স্কাউটিং ও বার্ষিক বনভোজনের মতো নানা কার্যক্রম। বিদ্যালয়টিতে প্রবেশ করলে যে কারও মনে হবে—এটি যেন শতভাগ আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় গড়া একটি স্কুল।

পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী হুসনেয়ারা খাতুন জানায়, “মাল্টিমিডিয়া ক্লাসে আমরা চিত্র, কবিতা, গল্পসহ অনেক কিছু সহজে শিখতে পারছি। তবে শিক্ষক সংকট আমাদের বড় সমস্যা।” অপর এক শিক্ষার্থী জানায়, বর্ষায় স্কুলে যাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে, ভেজা কাদায় স্কুল ড্রেস ময়লা হয়ে যায়। ভালো একটি রাস্তা হলে পড়াশোনায় আরও মনোযোগী হওয়া সম্ভব হতো।

বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আনোয়ার হোসেন বলেন, “প্রত্যন্ত অঞ্চলেও মাল্টিমিডিয়া পাঠদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা উৎসাহ নিয়ে পড়াশোনা করছে। খেলতে খেলতেই শিখছে তারা।”

এই বিদ্যালয়ের পরিবেশ দেখার জন্য আশেপাশের অন্যান্য স্কুলের শিক্ষকরা আসেন। হেমন্তবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সোহেল রানা বলেন, “শিক্ষক সংকট থাকলেও এই স্কুলে কোনো বিশৃঙ্খলা নেই। শিক্ষার্থীরা শৃঙ্খলাপূর্ণ, মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে ক্লাস করছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও শিক্ষার মান এতটা উন্নত হতে পারে—এটি তার প্রমাণ।”

বনবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাহানারা খাতুন বলেন, “অ্যাসেম্বলিতে শিক্ষার্থীদের শৃঙ্খলা আমাকে মুগ্ধ করেছে। এখান থেকে আমি অনুপ্রাণিত হয়ে আমার বিদ্যালয়েও এই শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে চাই।”

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কে. এম. রহমতুল বারী বলেন, “একসময় এই গ্রামে ১২০০ ভোটারের মধ্যে মাত্র ৫০ জন শিক্ষার্থী পড়ত। এখন সেই সংখ্যা বেড়েছে। তবে অবকাঠামো উন্নয়ন, ভালো রাস্তা এবং শিক্ষক সংকট নিরসন জরুরি।”

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ছানোয়ার হোসেন জানান, বর্ষার কারণে রাস্তাঘাট ভেঙে গেছে। প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত সংস্কারের ব্যবস্থা করা হবে। তাঁর মতে, প্রত্যন্ত এলাকা হয়েও এই বিদ্যালয়টি এখন অন্য স্কুলের জন্য অনুকরণীয় মডেল।

বর্তমানে সাতজন শিক্ষকের স্থলে মাত্র চারজন শিক্ষক দিয়ে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলছে। দুর্বল যোগাযোগব্যবস্থার মাঝেও শিক্ষার মান যে কতটা উন্নত করা যায়, তার জীবন্ত উদাহরণ পংখারুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এরই স্বীকৃতি হিসেবে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সিরাজগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন।

প্রতিকূলতা আর সীমাহীন বাধা পেরিয়ে চলনবিলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা পংখারুয়া বিদ্যালয় আজ কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়; এটি হলো স্বপ্নপূরণের সোপান, আলোকিত ভবিষ্যতের প্রতীক।