সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার মাকড়শন এলাকায় ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় শামুক সংগ্রহ। ইতোমধ্যে সেখানে গড়ে উঠেছে একাধিক শামুকের আড়ৎ। প্রতিদিনই এখানে চলে জমজমাট ক্রয়-বিক্রয়, আর এভাবেই ধ্বংসের মুখে পড়ছে চলনবিলের জীববৈচিত্র্য।
রাতভর বিশেষ জাল ফেলে শামুক সংগ্রহ করেন স্থানীয়রা। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ছাড়াও নাটোরের সিংড়া ও গুরুদাসপুর এলাকার বিভিন্ন জলাশয় থেকে বস্তায় বস্তায় শামুক তোলা হয়। ভোর হতেই নৌকাভর্তি এসব শামুক আড়তে পৌঁছায়, সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়। মাছের ঘের ও হাঁসের খামারে এসব শামুকের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
বর্তমানে প্রায় ২০ থেকে ২৫টি আড়তে প্রতিদিন দেড় থেকে দুই টন শামুক কেনাবেচা হচ্ছে। কামাড়শোন, দিঘি সগুনা, কুন্দল মাকড়শন, মান্নাননগর, ঘরগ্রাম ও মাগুরা বিনোদসহ আশপাশের এলাকায় প্রতিদিন প্রায় ৫০০ নৌকায় শামুক ও ঝিনুক আহরণ হয়। ব্যবসায়ীরা নৌকা ও জাল সরবরাহ করে এই শিকারকে আরও বেগবান করছে। ফলে প্রতিবছর কোটি টাকার শামুকের লেনদেন হচ্ছে চলনবিলে।
প্রতিটি নৌকায় সাধারণত ৪-৫ জন মিলে ২৫-৩০ বস্তা শামুক সংগ্রহ করেন। নৌকা প্রতি শামুক বিক্রি হয় তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায়। তবে তেল ও অন্যান্য খরচ বাদ দিলে খরচ দাঁড়ায় ৯০০ থেকে ১১০০ টাকা। কৃষকরা জানান, বর্ষার মৌসুমে যখন চাষাবাদ বন্ধ থাকে, তখন পেটের দায়ে তারা শামুক ধরেন।
শামুক ব্যবসায়ী কামাল জানান, স্থানীয়দের কাছ থেকে শামুক কিনে খুলনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন মাছের খামারে সরবরাহ করা হয়। মূলত তিন-চার মাস বর্ষাকালেই এ ব্যবসা চলে।
তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, গত ৭-৮ বছর ধরে চলনবিলে নির্বিচারে শামুক-ঝিনুক নিধন চলছে। প্রকাশ্যে এই ব্যবসা হলেও কর্তৃপক্ষের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। অথচ শামুক ও ঝিনুক চলনবিলের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় অপরিহার্য।
সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, “সামান্য পরিমাণ আহরণে ক্ষতি নেই। কিন্তু অতিরিক্ত আহরণের ফলে পানির প্রাকৃতিক ফিল্টার নষ্ট হয়ে যায়। এতে শুধু ইকোসিস্টেম নয়, জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়ে।”
তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুসরাত জাহান জানান, শামুক আহরণকারীরা যখন বিক্রির চেষ্টা করবে তখন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কয়েকটি স্থানের খোঁজ পাওয়া গেছে। অন্যদিকে নাটোরের সিংড়া উপজেলার ইউএনও মাজহারুল ইসলাম বলেন, “শামুক আহরণ রোধে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শুরু হলেই আমরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করব।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শামুক শুধু মাছের খাদ্য নয়; এটি পানির ক্ষুদ্র জীব খেয়ে জলাশয়কে পরিষ্কার রাখে এবং মাটির উর্বরতা বজায় রাখে। নির্বিচারে শিকার চলতে থাকলে চলনবিলের পানি দূষিত হবে, মাছের সংখ্যা কমে যাবে এবং জমির উর্বরতা হ্রাস পাবে। সব মিলিয়ে চলনবিলের জীববৈচিত্র্য ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়বে।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ লুৎফর রহমান হীরা
হেড অফিসঃ ১/ জি,আদর্শ ছায়ানীড়, রিংরোড, শ্যামলী, আদাবর ঢাকা - ১২০৭।
স্বত্ব © ২০২৫ চলনবিলের সময়