নাটোর জেলার গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজীপুর গ্রামে অবস্থিত চলনবিল জাদুঘর একসময় ছিল চলনবিল অঞ্চলের গৌরব, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ভাণ্ডার। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই জাদুঘর আজ অবহেলা ও অযত্নে হারিয়ে যেতে বসেছে। বিলুপ্তির মুখে পড়েছে এখানকার শতাব্দী প্রাচীন নিদর্শন ও লোকসংস্কৃতির দলিল।
প্রতিষ্ঠার ইতিহাস
চলনবিলের মানুষের সংস্কৃতি, কৃষি ও জলজ জীবনের ইতিহাস সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ১৯৭৮ সালে জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠা করেন স্থানীয় শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আবদুল হামিদ। ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংগৃহীত বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, প্রাচীন মৃৎপাত্র, কৃষি সরঞ্জাম, ঐতিহাসিক দলিলপত্র ও লোকজ উপকরণ দিয়ে শুরু হয় এই জাদুঘরের যাত্রা।
পরবর্তীতে স্থানীয় জনগণ, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও নরওয়ের একটি দাতা সংস্থার সহযোগিতায় জাদুঘরের স্থায়ী ভবন নির্মিত হয়। ১৯৮৯ সালে এটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে আসে বলে জানা যায়। আবার কিছু সূত্রে ১৯৯৪ সালে সরকারীকরণের কথা উল্লেখ রয়েছে।
উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য
চলনবিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল এলাকা—প্রায় ৩২টি নদী-নালায় সংযুক্ত এই বিশাল জলাভূমি একসময় ছিল গ্রামীণ জীবনের প্রাণকেন্দ্র।
এই অঞ্চলকে ঘিরে যে কৃষি, মাছধরা, নৌকার সংস্কৃতি ও লোকজ ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল, তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার লক্ষ্যেই তৈরি হয় চলনবিল জাদুঘর।
জাদুঘরটি চলনবিল অঞ্চলের প্রাচীন সভ্যতার দলিল হিসেবে দেশের শিক্ষার্থী, গবেষক ও পর্যটকদের জন্য একটি অমূল্য কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত।
সংগ্রহ ও প্রদর্শনী জাদুঘরে ছিল—
প্রাচীন যুগের মাটির পাত্র ও টেরাকোটা নিদর্শন,
শস্য পরিমাপের কাঠের দণ্ড, লাঙ্গল, পাল, ঘড়ি ও পুরনো কৃষি সরঞ্জাম,
বিল এলাকার মানুষের ব্যবহৃত পুরনো পোশাক, বাদ্যযন্ত্র ও মাছ ধরার ফাঁদ,
নৌকা সংস্কৃতির ছবি, বিলের জীববৈচিত্র্যের দলিল,
এবং স্থানীয় ইতিহাস, কবিতা, দলিল ও নানা পাণ্ডুলিপি।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসব সংগ্রহের অনেক কিছুই আর দেখা যায় না। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বহু প্রত্নবস্তু অবহেলায় নষ্ট বা নিখোঁজ হয়েছে।
বর্তমান অবস্থা
স্থানীয়দের অভিযোগ, বর্তমানে জাদুঘরটি প্রায় অচল অবস্থায় পড়ে আছে। প্রতিদিনই ধুলায় ঢেকে থাকে গ্যালারি ও প্রদর্শনী সামগ্রী। দর্শনার্থীর আগমনও একেবারে সীমিত।
সরকারি রক্ষণাবেক্ষণ না থাকায় ভবনটির কিছু অংশ জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে, আর নিযুক্ত কর্মচারীর ঘাটতি থাকায় নিয়মিত প্রদর্শনীও বন্ধের উপক্রম।
এমনকি অনেক মূল্যবান প্রত্নবস্তু স্থানীয়দের সহায়তায় সংগ্রহ করা হলেও বর্তমানে সেগুলোর হদিস মিলছে না বলে জানা যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
স্থানীয় শিক্ষক ও সংস্কৃতি কর্মীদের মতে, চলনবিল জাদুঘর কেবল নাটোর নয়, এটি বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির এক জীবন্ত দলিল। সময়মতো সংরক্ষণ না করলে চলনবিলের ইতিহাস চিরতরে হারিয়ে যাবে।
তারা জাদুঘরটি পুনর্গঠনের জন্য সরকারের সংরক্ষণ প্রকল্প, ডিজিটাল আর্কাইভ এবং পর্যটন উন্নয়ন উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
পুনরুজ্জীবনের আহ্বান
চলনবিল জাদুঘর আজও চলনবিল অঞ্চলের মানুষের গর্ব। সঠিক সংরক্ষণ, আধুনিক প্রদর্শনী কৌশল ও পর্যটন সুযোগ বাড়ালে এটি আবারও হয়ে উঠতে পারে উত্তরবঙ্গের অন্যতম ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক আকর্ষণ।
চলনবিলের ইতিহাস বাঁচাতে তাই এখনই দরকার সরকারি উদ্যোগ ও স্থানীয়দের সম্মিলিত প্রয়াস।
পরিশেষে বলা যায়, চলনবিল জাদুঘর শুধু একটি ভবন নয়, এটি উত্তরবঙ্গের জলাভূমির মানুষের সংগ্রাম, সভ্যতা ও জীবনচিত্রের প্রতিচ্ছবি। সময়ের অবহেলায় এই জাদুঘর যদি হারিয়ে যায়, তবে হারিয়ে যাবে চলনবিলের প্রাণস্পন্দন—একটি সমগ্র অঞ্চলের ইতিহাস। তাই এখনই প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগে চলনবিল জাদুঘরকে পুনরুজ্জীবিত করার।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ লুৎফর রহমান হীরা
হেড অফিসঃ ১/ জি,আদর্শ ছায়ানীড়, রিংরোড, শ্যামলী, আদাবর ঢাকা - ১২০৭।
স্বত্ব © ২০২৫ চলনবিলের সময়