
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলা সদর থেকে দক্ষিণে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে শান্ত-নিবিড় উলিপুর গ্রাম। চলনবিলের পাড়ঘেঁষা এই গ্রামটি এখন পরিচিত ‘পাখির গ্রাম’ হিসেবে। গ্রামের কেন্দ্রজুড়ে রয়েছে শতাধিক বিঘা আয়তনের একটি প্রাচীন দিঘি, যার চারপাশে গড়ে উঠেছে বসতবাড়ি আর সবুজ গাছপালা। সেই গাছগুলোতেই বহু বছর ধরে বাসা বেঁধেছে শত শত শামুকখোল পাখি। সকালবেলা তাদের ডাক আর ওড়াউড়িতে মুখর হয়ে ওঠে পুরো এলাকা।
প্রতিদিন ভোরে সূর্যের আলো ফোটার আগেই পাখির দল উড়ে যায় আশপাশের বিলাঞ্চলে খাবারের খোঁজে। কেউ শামুক আর ছোট মাছের সন্ধানে বিলের পানিতে নেমে পড়ে, কেউ বা ডানা মেলে দিঘির ওপরে ভেসে বেড়ায়। এই দৃশ্য মুগ্ধ করে স্থানীয় বাসিন্দা থেকে শুরু করে দূরদূরান্তের আগন্তুক দর্শনার্থীদেরও।
উলিপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আরশেদ আলী বলেন, “প্রায় এক যুগ আগে শামুকখোল পাখিরা এখানে এসে গাছে বাসা বাঁধে। এরপর থেকেই প্রতি বছর বাচ্চা ফোটায়, সংখ্যাও বেড়ে যায়। তখন থেকেই আমরা ঠিক করি— কেউ পাখিদের বিরক্ত করব না, অন্য কাউকেও করতে দেব না।”
গ্রামের গৃহবধূ মাহফুজা বেগম জানান, আগে তাঁদের গ্রামে শুধু আত্মীয়স্বজনরা বেড়াতে আসতেন। এখন সারাদেশের মানুষ আসে শুধু পাখি দেখতে। “আমরা পাখিদের বিশ্রামের জন্য দিঘির পানিতে বাঁশ ও কঞ্চি বসিয়ে ঘর বানিয়েছি। মাঝেমধ্যে খাবারও দিই,” বলেন তিনি গর্বভরে।

পরিবেশবাদী সংগঠন ‘স্বাধীন জীবন’-এর পরিচালক মো. আবদুর রাজ্জাক জানান, এই গ্রামে দেখা পাওয়া শামুকখোল পাখিগুলো এশীয় প্রজাতির। এরা বাংলাদেশের নিজস্ব আবাসিক পাখি—অতিথি নয়। মাছ, কাঁকড়া, ব্যাঙসহ নানা জলজ প্রাণী এদের প্রধান খাদ্য। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভুটানসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এদের দেখা যায়। উপযুক্ত পরিবেশ ও পর্যাপ্ত খাবার পেলে তারা সাধারণত এক জায়গাতেই থেকে যায়। এই প্রজাতিটি এখন দেশের সংরক্ষিত প্রাণীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত।
তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নুসরাত জাহান বলেন, “উলিপুর দিঘি ছাড়াও তাড়াশে আরও কয়েকটি স্থানে পাখির অভয়ারণ্যের খোঁজ পাওয়া গেছে। এসব জায়গায় পাখিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রশাসন বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে।”
গ্রামবাসীর সচেতনতা ও ভালোবাসায় এখন উলিপুর দিঘি শুধু প্রকৃতির নয়, পরিবেশ সংরক্ষণেরও এক অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠেছে।