
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলায় তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির সিনিয়র ইলেকট্রিশিয়ান মো. আসাদুজ্জামান প্রকাশ্যে অফিসে যাতায়াত করছেন—এমন অভিযোগে জনমনে ক্ষোভ ও প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। সাজাপ্রাপ্ত একজন সরকারি কর্মকর্তা কীভাবে অবাধে চলাফেরা করছেন—এ প্রশ্ন এখন তিতাস গ্যাস থেকে শুরু করে দুদক ও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
২০২৫ সালের ৭ আগস্ট ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬ আসামি মো. আসাদুজ্জামান ও তার স্ত্রীকে দুর্নীতির অভিযোগে তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা জরিমানা (অনাদায়ে তিন মাসের অতিরিক্ত কারাদণ্ড) প্রদান করেন।
মামলা নম্বর ছিল যথাক্রমে ০৬/২০২৩ ও ০১/২০২৩।
রায় ঘোষণার পর আদালত থেকে রূপগঞ্জ থানায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাঠানো হলেও দুই মাসের বেশি সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
বরং অভিযোগ রয়েছে—আসাদুজ্জামান প্রতিদিন নিয়মিতভাবে কাওরান বাজারস্থ তিতাস গ্যাসের অফিসে উপস্থিত থাকেন এবং স্বাভাবিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন, যেন তার কোনো সাজা হয়নি।
স্থানীয় সূত্র ও নাগরিক সমাজের অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের নীরবতা রহস্যজনক।
ফতুল্লার স্থানীয় বাসিন্দা মো. গিয়াস উদ্দিন এক লিখিত অভিযোগে বলেন,
“রায় ঘোষণার এতদিন পরও আসামিকে গ্রেপ্তার না করা শুধু আইনের প্রতি অবজ্ঞাই নয়, বরং এটি প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের জ্বলন্ত উদাহরণ। পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে ‘ম্যানেজ’ করার সুযোগ দিয়েছে বলেই তিনি আজও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।”
দুদকের মামলায় আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপন করা।
তদন্তে জানা যায়, দাপা ইদ্রাকপুর (ফতুল্লা) এলাকায় মাত্র ৩ শতক জমি দেখালেও বাস্তবে ১২ কাঠা জমির ওপর ১০ তলা ভবন নির্মাণ করেছেন তিনি।
সম্পদ বিবরণীতে মাত্র ১টি ফ্ল্যাট দেখালেও বাস্তবে তিনি ১৪ তলা ভবনের মালিক, যেখানে রয়েছে ৬টি ফ্ল্যাট।
এছাড়া তিনি বর্তমানে একটি প্রাইভেট কার ব্যবহার করছেন এবং অতীতে ‘রানী মহল’ ও ‘মতি মহল’ নামে দুটি হায়েস মাইক্রোবাসের রেন্ট-এ-কার ব্যবসা পরিচালনা করতেন—যা সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখ নেই।
মাতুয়াইল এলাকায় ৪৪ জনের নামে নির্মাণাধীন একটি ভবনে তার যৌথ বিনিয়োগ রয়েছে এবং রূপগঞ্জের মাঝিনা নদীর পাড়ে মামা-খালার নামে জমি কিনে পরে দানপত্রের মাধ্যমে নিজের নামে নিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগকারী গিয়াস উদ্দিন বলেন,“দুদকের তদন্তে অনেক গোপন সম্পদ বাদ পড়েছে। পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্ত হলে আসামির বিরুদ্ধে আরও বিপুল পরিমাণ দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যেত।”
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি মো. কামরুজ্জামান রনি বলেন,“যে দেশে দুদকের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা অবাধে অফিস করতে পারেন, সেখানে সাধারণ মানুষ আইনের প্রতি আস্থা রাখবে কীভাবে? এটি শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিরও চরম অবমূল্যায়ন।”
তিনি আরও বলেন, সরকারকে দ্রুত বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে আইনের শাসনের প্রতি মানুষের আস্থা পুনরুদ্ধার হয়।
এই ঘটনা শুধু একজন কর্মকর্তার নয়—এটি রাষ্ট্রীয় আইন প্রয়োগ ব্যবস্থার দুর্বলতা, প্রশাসনিক উদাসীনতা ও আইনের শাসনের প্রতি অবহেলার প্রতিচ্ছবি।
জনমনে প্রশ্ন জেগেছে—দুদকের মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি যদি প্রকাশ্যে চাকরি করতে পারেন, তবে দুর্নীতি প্রতিরোধের ভবিষ্যৎ কোথায়?
তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ, দুদক, রূপগঞ্জ থানা পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও এ বিষয়ে কেউ কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য দিতে রাজি হননি।
তবে নাগরিক সমাজ ও স্থানীয় সচেতন মহলের দাবি—সরকার যেন বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তদন্ত করে, দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে, এবং সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করে।