
হিন্দু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা। দেবী দূর্গার মহিষাসুরবধ ও শুভশক্তির জয়ের স্মরণে এই পূজা আয়োজিত হয়। পুরাণ মতে, মহিষাসুর নামক অসুরকে পরাজিত করতে দেবতাদের শক্তি মিলে জন্ম হয় দেবী দূর্গার। দেবী দূর্গা শক্তির প্রতীক, যিনি মানবজীবন থেকে অশুভ দূর করে শুভের প্রতিষ্ঠা করেন।
বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত মূল পূজা চলে। তবে পূজার সূচনা হয় প্রতিপদ (প্রথমী) থেকেই। প্রতিটি দিনেই রয়েছে বিশেষ তাৎপর্য, ধর্মীয় আচার এবং কাহিনি।
প্রথমী (প্রতিপদ)
দুর্গাপূজার প্রস্তুতির সূচনা হয় এই দিনে। মণ্ডপে মৃৎশিল্পীরা দেবীর মূর্তি গড়ে তোলেন। পূজার জন্য অর্ঘ্য, সামগ্রী ও উপকরণ জোগাড় শুরু হয়। পুরোহিত মণ্ডপশুদ্ধি করেন এবং দেবীর আহ্বানের জন্য পরিবেশ তৈরি করা হয়।
দ্বিতীয়া
দেবীর আবাহনের জন্য দ্বিতীয় দিন বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়। অনেকে ঘরে বা পাড়ায় ছোট পরিসরে পূজার আয়োজন শুরু করেন। সেদিন দেবীর মূর্তিতে বস্ত্র পরানোসহ আনুষ্ঠানিক সাজসজ্জা হয়।
তৃতীয়া
তৃতীয় দিনে দেবীর প্রতি প্রাথমিক মন্ত্রোচ্চারণ, মঙ্গলাচরণ ও পাঠ অনুষ্ঠিত হয়। দেবীর চরণে প্রথম অর্ঘ্য নিবেদন করা হয়। স্থানীয়ভাবে এদিন দেবী দর্শন ও সামাজিক জমায়েতের সূচনা ঘটে।
চতুর্থী
এই দিনকে দেবীর ভাবনা-দিন বলা হয়। মণ্ডপে আলো, রঙিন সাজসজ্জা এবং বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনিতে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়। অনেক মণ্ডপে এই দিন থেকেই ভক্তদের আনুষ্ঠানিক আগমন শুরু হয়।
পঞ্চমী
পঞ্চমীতে মূর্তির চক্ষুদান (চোখ অঙ্কন) ও প্রানপ্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি হয়। দেবীর মুখচ্ছবি পূর্ণতা লাভ করে। পুরোহিতরা মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে দেবীকে পূর্ণ রূপে আমন্ত্রণ জানানোর প্রক্রিয়া শুরু করেন।
ষষ্ঠী (মহাষষ্ঠী)
ষষ্ঠী থেকেই মূল পূজা শুরু হয়। এদিন ‘বোধন’, ‘অধিবাস’ ও ‘আমন্ত্রণ’ হয়। সন্ধ্যায় দেবী দুর্গাকে আবাহন করা হয় এবং দেবীর প্রাণপ্রতিষ্ঠা সম্পন্ন হয়। এই দিন থেকেই দেবীর আগমন উদযাপিত হয়।
সপ্তমী
সপ্তমীতে দেবীর নবরূপ পূজা শুরু হয়। সকালে কলাবউ স্নান করিয়ে দেবীর পাশে স্থাপন করা হয়। দেবীকে অর্ঘ্য নিবেদন, স্তোত্রপাঠ ও বিশেষ ভোগ দেওয়া হয়। ভক্তদের আনুষ্ঠানিক ভক্তিসংগীত, আরতি এবং প্রসাদ বিতরণ চলে।
অষ্টমী
অষ্টমী দুর্গাপূজার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। এদিন দেবীর কাছে ভক্তরা প্রার্থনা করেন অশুভ শক্তির বিনাশের জন্য। ‘সন্ধিপূজা’ অষ্টমীর বিশেষ আচার—যখন অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে ১০৮ প্রদীপ জ্বালিয়ে, ১০৮ পদ্মফুল দিয়ে দেবীর আরাধনা করা হয়। অনেক স্থানে কুমারী পূজার আয়োজনও হয়।
নবমী
নবমী পূজা মূলত দেবীর বিজয়গাথা স্মরণে। এই দিনে মহিষাসুরবধের কাহিনি পাঠ করা হয়। ভোগে থাকে খিচুড়ি, পায়েসসহ নানাবিধ খাদ্য। দেবীকে ধূপ-দীপ, যজ্ঞ এবং আরতির মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ পূজা নিবেদন করা হয়।
দশমী (বিজয়া দশমী)
দশমী দিনে দেবী দুর্গাকে বিদায় জানানো হয়। পূজার শেষ দিন সকালেই দেবীর পূজা হয় এবং বিকেলে প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে দেবীর গমন সম্পন্ন হয়। নারীরা দেবীর প্রতিমায় সিঁদুর পরিয়ে ‘সিঁদুর খেলা’ করেন এবং ভক্তরা একে অপরকে বিজয়ার শুভেচ্ছা জানান। বিজয়া দশমী মিলনোৎসব—এদিন আত্মীয়স্বজনের ঘরে ঘরে মিষ্টি বিতরণ হয় এবং শুভেচ্ছা বিনিময় করা হয়।
(লেখক- লুৎফর রহমান হীরা
সম্পাদক ও প্রকাশক
ত্রৈমাসিক চলনবিলের সময়।)