দেহ ঠিক তো সব ঠিক

: চলনবিলের সময়
প্রকাশ: ১ মাস আগে

9

গ্রামীণ সমাজে মানুষের জীবনধারা এখনো অনেকটা শারীরিক সামর্থ্য আর কর্মক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল। যতদিন শরীর ভালো থাকে, ততদিন মানুষ সম্মানিত, সক্রিয় ও সমাজে প্রভাবশালী থাকে। কিন্তু শরীর ভেঙে পড়লেই পাল্টে যায় ছবিটা। তখন যেন সেই মানুষটি হয়ে ওঠেন অপ্রয়োজনীয়, অনেক সময় বোঝা।

যুবক বয়সে সম্মান ও মূল্য

যুবক বয়সে মানুষ মাঠে-ঘাটে কাজ করে, দিনমজুর হোক বা কৃষক, পরিশ্রম দিয়েই সংসার টিকিয়ে রাখে। তখন পরিবারের কাছে সে ভরসা, সমাজে তার পরামর্শের মূল্য আছে। গ্রামে মুরব্বিরা যতদিন শারীরিকভাবে সক্ষম থাকেন, ততদিন তাদের কথা শুনে সিদ্ধান্ত হয়, ঝগড়া মেটানো হয়। তখন মানুষ বলে—“ওনার কথা শেষ কথা।”

বার্ধক্য এলে বাস্তবতা বদলায়

কিন্তু বয়স যখন বাড়তে থাকে, তখন শরীর আর আগের মতো কাজ করতে পারে না। শারীরিক দুর্বলতা এসে যায়, রোগ-ব্যাধি ঘন ঘন আক্রমণ করে। তখনই দেখা যায় মানুষের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।
সবচেয়ে নিকটজন—স্ত্রী বা স্বামী—ও তখন আর আগের মতো আগলে রাখতে পারেন না। ছেলে-মেয়েরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজের সংসার, চাকরি বা ব্যবসা নিয়ে। অনেকে তখন বাবা-মাকে সময় দিতে চায় না। অনেক ক্ষেত্রে ছেলের বউরা মনে করে—শ্বশুর-শাশুড়ির অসুস্থতা শুধু ঝামেলার বোঝা। মনে হয়—“মরলেই বাঁচি।”

অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ও ভালোবাসা

অর্থনৈতিক বাস্তবতাও এখানে বড় ভূমিকা রাখে। যখন শরীর সুস্থ থাকে, তখন কাজ করে আয় থাকে। আয় থাকলে সমাজ-পরিবারে মূল্য থাকে, সবাই খোঁজ নেয়, সম্মান করে। কিন্তু অসুস্থ হলে যখন আয় বন্ধ হয়ে যায়, তখন সম্মানও যেন হারিয়ে যায়।
গ্রামে অনেক সময় বলা হয়—“যতদিন আয় আছে, ততদিন মায়া আছে।” কথাটি নির্মম হলেও বাস্তব।

সম্মানের ভারসাম্য

এমন বাস্তবতা থেকে মানুষ বলে—“দেহ ঠিক তো সব ঠিক।”
অর্থাৎ শারীরিক সক্ষমতা থাকলেই সবকিছু থাকে—সম্মান, ভালোবাসা, কদর। আর শরীর ভেঙে পড়লেই সব যেন শেষ হয়ে যায়।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়—শুধু দেহই কি মানুষের মূল্য নির্ধারণের একমাত্র মাপকাঠি?
সমাজ যদি সত্যিকারের মানবিক হতে চায়, তবে অসুস্থ, বয়স্ক ও কর্মক্ষমতাহীন মানুষকেও সমান মর্যাদা দিতে হবে।

মানবিকতার শিক্ষা

আজকের তরুণ প্রজন্মকে মনে রাখতে হবে—একদিন তাদেরও বয়স হবে। দেহ একদিন ভেঙে পড়বেই। তখন তারা-ও চাইবে সম্মান, ভালোবাসা আর যত্ন। তাই এখন থেকেই প্রবীণদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের সম্মান দেওয়া সমাজ ও পরিবারের দায়িত্ব।

 

পরিশেষে,বাস্তবতা হলো—মানুষের শরীর সুস্থ থাকলেই সব সহজ মনে হয়, ভালোবাসা ও সম্মান মেলে। কিন্তু সত্যিকারের মানবিক সমাজ গড়তে হলে আমাদের এই ধারা ভাঙতে হবে। কেবল কর্মক্ষমতার ভিত্তিতে নয়, মানবিক সম্পর্কের ভিত্তিতে মানুষের মর্যাদা নির্ধারণ করতে হবে।
তখনই আমরা বলতে পারব—
“দেহ ভেঙে গেলেও, ভালোবাসা অটুট।”