
বাংলার বর্ষা যেন প্রকৃতির ক্যানভাসে আঁকা এক ভেজা প্রেমপত্র। এই ঋতুর প্রতিটি ফোঁটা বৃষ্টি শুধু প্রকৃতিকে নয়, ভ্রমণপিপাসু হৃদয়কেও জাগিয়ে তোলে। শহরের কোলাহল ছেড়ে প্রকৃতির কোলে একটু প্রশান্তি খুঁজতে চাইলে, বর্ষা হতে পারে আপনার ভ্রমণের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।
মেঘ, টিনের চালে পড়া বৃষ্টির সুর, ভিজে মাটির গন্ধে পুরোনো স্মৃতির হাহাকার- সব মিলিয়ে এ যেন প্রকৃতির এক প্রেমপত্র, যা প্রতি বছর ঠিক সময়মতোই এসে পৌঁছে আমাদের হৃদয়ে। জানি, শহর আপনাকে ব্যস্ত রেখেছে। জানালার কাচ বেয়ে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির ফোঁটায় আপনি হয়ত স্বপ্ন দেখেন প্রকৃতি আপনাকে ডাকছে- ভেজা, রোমাঞ্চকর, একান্ত কোলাহলে। সময় এসেছে সেই ডাক শোনার, ছাতা ফেলে রেখে বৃষ্টিতে ভেজার, পাহাড়ের ধারে দাঁড়িয়ে মেঘ ছোঁয়ার। এই লেখাটা সেই স্বপ্নকে জীবন্ত করার আহ্বান।
সাজেক যেন প্রকৃতির হাতে আঁকা এক ক্যানভাস- যেখানে পাহাড়, সবুজ বন আর সাদা মেঘ একসঙ্গে বসে গল্প বলে। বর্ষা এলেই এই গল্প হয়ে ওঠে আরও সজীব, আরও স্বপ্নময়। তখন পাহাড়ের গায়ে গড়িয়ে নামে বৃষ্টি, পথঘাট হারিয়ে যায় কুয়াশার চাদরে, আর মেঘ এসে ধীরে ধীরে ছুঁয়ে যায় মানুষের গাল।

সাজেকের পথে চলতে চলতে মনে হয়, আপনি কোনো বাস্তব জায়গায় নন, এ যেন এক স্বপ্নের ভেতর হাঁটছেন। কখনো মেঘ মাথার ওপরে নয়, বরং নিচে গড়িয়ে যায়, আর আপনি দাঁড়িয়ে থাকেন আকাশের কিনারায়। কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় উঠে চারপাশে তাকালে শুধু মেঘের সাদা সাগর, তার মাঝে ডুবে থাকে গ্রামের টিনের ছাউনি, অরণ্য আর পাহাড়ের রেখা।
সিলেটের বর্ষা যেন কোনো এক কবির মলিন-স্নিগ্ধ কবিতা- মৃদু, ভেজা আর একগুচ্ছ রহস্যময়। যখন আকাশের নীল ছুঁয়ে যায় সাদা মেঘের গাঢ় চাদরে, তখন জৈন্তাপুর থেকে জাফলং, লালাখাল থেকে বিছানাকান্দি; সবখানেই শুধু জল আর সবুজের এক অপার দোলাচল শুরু হয়। পাহাড়ি নদীগুলো তখন নতুন রূপে সাজে, তাদের স্রোত হয়ে ওঠে এক হৃদয়স্পর্শী জলরাগের মূর্ছনা, যা কানে মধুর সুরের মতো বাজে।

বর্ষার সময় পান্থুমাই ঝরনা যেন ঘুম থেকে জেগে ওঠে। ভারতের সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত এই ঝরনা দূর থেকে দেখা যায় বরফঝরা এক গিরিপথের মতো, যদিও তার উৎস একেবারে বর্ষার বর্ষণই। ঝরনার প্রবাহের সঙ্গে মিশে থাকে পাশের খাসিয়া গ্রামের সরল জীবনধারা- যা এই প্রকৃতির অমোঘ সৌন্দর্যের সঙ্গে মেলবন্ধন গড়ে তোলে, তৈরি করে এক অনন্য নিস্তব্ধতা আর প্রাকৃতিক রোমান্স।
টাঙ্গুয়ার হাওর কেবল একটি ভৌগোলিক স্থান নয়- এ এক অনুভব, এক জলজ জগতের নীরব প্রেমকাব্য। বর্ষা এলে হাওর জেগে ওঠে নিজের সমস্ত রূপ, রস, গন্ধ ও শব্দ নিয়ে। তখন মাঠঘাট সব ডুবে গিয়ে সৃষ্ট হয় এক বিশাল জল-আকাশের রাজ্য, যেখানে আকাশ মিশে যায় পানির আয়নায়, আর আপনি হারিয়ে যান সেই অসীম নীলের ভেতর।

আর এই জলের বুকেই ভেসে বেড়ায় মানুষ, জীবন, সময়। মাঝির কণ্ঠে ভেসে আসে ভাটিয়ালি, রান্নার হাঁড়িতে ফুটে ওঠে সদ্য ধরা মাছ—সব কিছুতেই থাকে এক নির্ভেজাল বাঙালিয়ানা, এক সহজ অথচ গভীর সৌন্দর্য।
যদি আপনার হৃদয় লালন করে একটু অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ, তাহলে বর্ষাকালেই পা বাড়ান বান্দরবানে। বর্ষার মৃদু বৃষ্টিতে ভেজা পাহাড়ি পথ যেন নতুন প্রাণ পায়, আর প্রাণের গভীরে জাগে এক অনন্য স্পন্দন। থানচি, রেমাক্রি, নাফাখুম, আমিয়াখুম- এই স্বপ্নিল নামগুলো বর্ষার জলে আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে, বৃষ্টির ফোঁটার সঙ্গে মিশে যেন নতুন কাব্য রচনা করে।

বৃষ্টির ছোঁয়ায় সিক্ত পাহাড়ি ট্র্যাকিংয়ে পা ফেলুন, যেখানে প্রতিটি ধাপের সঙ্গে সঙ্গী হয় ঝরনার সুরের গর্জন। পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসা ঝর্ণার শীতল জলে ভেজা বাতাসে আপনার মন হয়ে উঠবে তরতাজা। পাহাড়ি নদীর পাড়ে তাঁবু গেড়ে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা যেমন রহস্যময়, তেমনি একান্তে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার এক অসাধারণ সুযোগ।
বাংলাদেশের জলপ্রপাতের মধ্যে মাধবকুণ্ডের নামই সবার আগে মনে আসে। বিশেষ করে বর্ষাকালে, এই প্রাকৃতিক বিস্ময় যেন আরও বেশি প্রাণবন্ত হয়ে উঠে। মৌলভীবাজারের পাহাড়ি অরণ্যের কোলে বয়ে চলা পানির সেই অনবদ্য স্রোত তখন তীব্রতা এবং শক্তিতে পূর্ণ হয়, প্রতিটি ফোঁটার সঙ্গে মিশে যায় প্রকৃতির এক বাঘা গর্জন। চারপাশের সবুজের অন্তরে ঝরনার শব্দ মিশে এক অনবদ্য সুর সৃষ্টি করে, যা মনকে করে তোলে প্রাণবন্ত ও উদ্দীপিত।

বর্ষার ধারা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাধবকুণ্ডের রূপ যেন এক নতুন অধ্যায় খুলে দেয়। জলরাশির খেলা, জলছটায় ভেজা পাথরের বুকে নাচন, আর ঝরনার কোলাহলে সারা বনভূমি যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। একে একে সমস্ত ইন্দ্রিয় জাগ্রত হয়, আর আপনি অনুভব করেন প্রকৃতির এক গভীর স্পর্শ।
বর্ষাকালীন বৃষ্টি যখন সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনভূমির ওপর ঝরতে শুরু করে, তখন এই পৃথিবীর এক বিরল প্রাকৃতিক চিত্র সামনে আসে। বৃষ্টির স্পর্শেই গাছেরা যেন সজীব হয়ে ওঠে, শাখা-প্রশাখা কাঁপে এক রহস্যময় সুরে। ধীরে ধীরে বৃষ্টি বাড়তে থাকলে, শাখা-প্রশাখাগুলো নীরব এক সুরে কাঁপতে থাকে, যেন প্রকৃতি নিজেই মধুর এক গান গাইছে। ম্যানগ্রোভের পাতা-পাখায় পড়া ঝলমলে জলরাশি যেন এই জীবন্ত বনভূমিকে এক অপূর্ব শিল্পকর্মে পরিণত করে।

বর্ষার এই সময় নদী আর খালগুলো ফুলে ওঠে, স্রোত আরও গভীর ও তীব্র হয়, আর জলরাশির মৃদু গর্জন পুরো বনভূমিকে এক সুরেলা মঞ্চে রূপান্তরিত করে। বৃষ্টির ফোঁটার সঙ্গে মিশে ঝরনার প্রবাহ, হরিণের চুপচাপ পায়ের শব্দ, আর দূর থেকে বাঘের গর্জন- এই সব মিলিয়ে বর্ষাকালে সুন্দরবন হয়ে ওঠে এক প্রাণবন্ত, রহস্যময় ও সঙ্গীতময় জায়গা। চারপাশে সবুজের ঘনত্ব বেড়ে যায়, বাতাসে ভেসে বেড়ায় মাটির গন্ধ আর নরম বর্ষার সুর।
বর্ষার সময় সুন্দরবন ঘুরে দেখা মানে শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করা নয়, বরং একটি সম্পূর্ণ ইন্দ্রিয়জড়িত অভিজ্ঞতা লাভ করা- যেখানে চোখ, কান, নাক ও স্পর্শ সবাই প্রকৃতির কোলে বিলীন হয়ে যায়। বর্ষার মায়ায় ভেজা এই বনভূমি, তার বন্যপ্রাণীর নীরব উপস্থিতি, আর বৃষ্টির ছোঁয়ায় ঝরনার জলরাশির নাচন আপনাকে নিয়ে যাবে এক অনন্য জগতে, যা হৃদয়ের গভীরে চিরকাল স্মৃত হয়ে থাকে।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ লুৎফর রহমান হীরা
হেড অফিসঃ ১/ জি,আদর্শ ছায়ানীড়, রিংরোড, শ্যামলী, আদাবর ঢাকা - ১২০৭।
স্বত্ব © ২০২৫ চলনবিলের সময়