বাংলার উত্তরাঞ্চলের পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলায় ইতিহাস আর ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে মোগল সম্রাট আকবরের স্মৃতিবিজড়িত মাসুম খাঁর তিন গম্বুজের শাহি মসজিদ। প্রায় পাঁচ শতাব্দী আগে নির্মিত এই মসজিদ শুধু ধর্মীয় উপাসনালয় নয়, বরং ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল হিসেবে সময়ের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে।
একসময় প্রমত্তা বড়াল নদীর তীরে অবস্থিত চাটমোহর ছিল একটি প্রাচীন বাণিজ্যকেন্দ্র ও পাঠশালার স্থান হিসেবে বিখ্যাত। সেই সময়েই সৈয়দ মোহাম্মদ মাসুম খাঁ এই স্থানে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৪৭ ফুট, প্রস্থ ২২ ফুট ৬ ইঞ্চি এবং উচ্চতা প্রায় ৪০ ফুট। ক্ষুদ্র ও পাতলা জাফরি ইট দিয়ে নির্মিত এই স্থাপনা মোগল স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন।
মসজিদটিতে রয়েছে তিনটি প্রবেশপথ এবং পশ্চিম দেয়ালে নামাজের জন্য তিনটি মিহরাব। কেন্দ্রীয় মিহরাবটি তুলনামূলকভাবে বড়, যা মূল গম্বুজের নিচে অবস্থিত। দোতলা অংশটির উচ্চতা প্রায় ৬ ফুট ৯ ইঞ্চি। স্থাপনার ভিত ও দেয়ালে সূক্ষ্ম অলংকরণ দেখা যায়। সময়ের বিবর্তনে অনেক অংশ ভেঙে গেলেও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর আশির দশকে মসজিদটি পুনর্নির্মাণ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়। বর্তমানে এটি একটি সরকারি সংরক্ষিত মসজিদ।
মসজিদের সামনে খণ্ডিত এক ফলকে ফারসি ভাষায় “ইল্লায়ার শাহ এব তালেমা শাহাদাত” কথাটি খোদাই করা রয়েছে। আগে মসজিদের মুখমণ্ডল খোলা থাকলেও সংরক্ষণের প্রয়োজনে তা বর্তমানে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ১৯০৪ সালেই স্থানীয়ভাবে প্রাচীন এই মসজিদ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
ঐতিহাসিক সূত্র ও অধ্যক্ষ আব্দুল হামিদের “চলনবিলের ইতিকথা” গ্রন্থ অনুযায়ী, সৈয়দ মোহাম্মদ মাসুম খাঁ ছিলেন সম্রাট আকবরের সেনাবাহিনীর একজন দক্ষ সৈন্যনেতা ও পাঁচ হাজারি মনসবদার। তার পূর্বপুরুষেরা আফগানিস্তানের রাজবংশীয় বংশোদ্ভূত ছিলেন। ১৫৭৯ সালে তিনি মোগল বাহিনী ছেড়ে বাংলা অঞ্চলের বারো ভূঁইয়ার সঙ্গে যোগ দেন এবং স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। কিন্তু পরবর্তীতে আকবরের সেনাপতি শাহবাজ খানের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তিনি ভাওয়ালের গভীর বনে আত্মগোপন করেন। ১৫৯৯ সালে ৪৪ বছর বয়সে তিনি মোগল বাহিনীর হাতে নিহত হন।
মাসুম খাঁর স্মৃতি ধরে রাখতে ও তার শাসনকাল স্মরণে রেখে নির্মিত হয় এই তিন গম্বুজবিশিষ্ট শাহি মসজিদ। ইতিহাসবিদদের মতে, চাটমোহরই একসময় তার রাজধানী হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
বর্তমানে মসজিদটির ভিতরে একসঙ্গে মাত্র দুই কাতার নামাজ আদায় করা যায়। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও জুমার নামাজ ছাড়াও ঈদের দুই জামাত অনুষ্ঠিত হয় এই মসজিদ প্রাঙ্গণে। শত শত বছর পেরিয়ে গেলেও এর গম্বুজ, অলংকরণ ও স্থাপত্যশৈলী এখনও দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে।
চলনবিলের বুক জুড়ে আজও দণ্ডায়মান এই মসজিদ কেবল প্রার্থনার স্থান নয়—এটি বাংলার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের এক অমূল্য ঐতিহ্য।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ লুৎফর রহমান হীরা
হেড অফিসঃ ১/ জি,আদর্শ ছায়ানীড়, রিংরোড, শ্যামলী, আদাবর ঢাকা - ১২০৭।
স্বত্ব © ২০২৫ চলনবিলের সময়