শাহজাদপুরে কুমড়ো বড়ি বিক্রি করে স্বাবলম্বী জাহানারা খাতুন

: বিশেষ প্রতিবেদক | চলনবিলের সময়
প্রকাশ: 2 weeks ago

86

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলায় শীত এলেই ঘরে ঘরে শুরু হয় কুমড়ো বড়ি তৈরির ব্যস্ততা। চালকুমড়া, মাসকলাইয়ের ডাল ও সামান্য মসলার মিশ্রণে তৈরি এই ঐতিহ্যবাহী খাবার শীতের অন্যতম জনপ্রিয় উপাদান। বিশেষ করে কৈ, শিং বা শোল মাছের ঝোলে এর স্বাদ অসাধারণ হওয়ায় স্থানীয় বাজার থেকে শুরু করে জেলা–উপজেলা হয়ে দেশের নানা প্রান্তে পাঠানো হয় কুমড়ো বড়ি।

এই কুমড়ো বড়ি তৈরির কাজকে পুঁজি করে শাহজাদপুরের গাঁড়াদহ ইউনিয়নের তালগাছী গ্রামের জাহানারা খাতুন আজ হয়েছেন স্বাবলম্বীর প্রতীক। স্থানীয়দের মতে, একসময় তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্বল্পআয়ের মানুষ। কিন্তু দুই দশকের বেশি সময় ধরে কুমড়ো বড়ি তৈরি ও বিক্রি করে আজ তিনি গড়ে তুলেছেন নিজেদের ঘরবাড়ি, শিক্ষিত করেছেন তিন সন্তানকে এবং নিশ্চিত করেছেন পরিবারের আর্থিক স্থিতি।

শীত এলেই বাড়ে উৎপাদন ব্যস্ততা

তালগাছী গ্রামের নারীদের এখন সবচেয়ে বড় ব্যস্ততা কুমড়ো বড়ি বানানোকে ঘিরে। জাহানারা খাতুন জানান, শীত আসার সঙ্গে সঙ্গেই বড়ি তৈরির তাগিদ বেড়ে যায়।
“এলাকার শত শত নারী এই কাজে জড়িত। নিজেরা খাওয়ার জন্য যতটুকু রাখি, তার বাইরে সব বিক্রি করি বাজারে,” বলেন তিনি।

ব্যবসায়ী মনোয়ারা জানান, আশ্বিন থেকে ফাল্গুন—এই ছয় মাস কুমড়ো বড়ি তৈরির মৌসুম। পরিবারিক প্রয়োজন মিটিয়ে বাকিটা পাইকারি বাজারে বিক্রি করাই তাদের প্রধান আয়।

খরচ কম, লাভ নিশ্চিত

তালগাছী গ্রামের আরেক উদ্যোক্তা মুনজুরুল বলেন, এক কেজি কুমড়ো বড়ি তৈরি করতে খরচ হয় ৭০–৭৫ টাকা। পাইকারি বাজারে বিক্রি হয় ৯০–৯৫ টাকায়। আর খুচরা বাজারে এর দাম ওঠে ১২০–১৩০ টাকায়। তাই অল্প পুঁজিতে ভালো লাভ হওয়ায় নারীরা এ পেশায় আগ্রহী হচ্ছেন।

কুমড়ো বড়ির ব্যবসায়ী নির্মল সরকার জানান, এখানকার বড়ির স্বাদ আলাদা হওয়ায় চাহিদা বেশি। স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে এটি সরবরাহ করা হচ্ছে পাবনা, ঢাকা ও রাজশাহীসহ বিভিন্ন জেলায়।

আরেক ব্যবসায়ী মো. মোস্তফা হোসেন বলেন, “সারা বছর কুমড়ো বড়ি বানানো হলেও শীতকালে চাহিদা সবচেয়ে বেশি। দেশি মাছের সঙ্গে রান্না করলে স্বাদ দ্বিগুণ হয়। বড়ি তৈরির প্রায় সব কাজই নারীরাই করেন।”

বড়ি তৈরির ধাপ—শ্রমসাধ্য হলেও লাভজনক

মাসকলাইয়ের ডাল কেজিতে ১০০–১২০ টাকা এবং চালকুমড়া ১৫–২০ টাকায় বিক্রি হয়। ৫ কেজি চালকুমড়া ও ২ কেজি মাসকলাইয়ের ডালের মিশ্রণে মানসম্মত কুমড়ো বড়ি তৈরি হয়।

প্রথমে মাসকলাই রোদে শুকিয়ে যাতায় ভেঙে পরিষ্কার করা হয়। এরপর ৫–৬ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রেখে খোসা ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। তারপর পাটায় বা মেশিনে পিষে চালকুমড়ার সঙ্গে মিশিয়ে তৈরি করা হয় বড়ির খামির।

ভোর থেকে রোদ উঠতেই বাড়ির আঙিনা, ছাদ বা খোলা জায়গায় সারি সারি বড়ি শুকানোর কাজ চলে। ২–৩ দিনের রোদে বড়ি সম্পূর্ণ শুকিয়ে প্রস্তুত হয়। রোদ কম পেলে ৩–৪ দিনও সময় লেগে যায়।

দারিদ্র্য থেকে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার গল্প

জাহানারা খাতুন জানান, ২০–২৬ বছর ধরে তিনি কুমড়ো বড়ি তৈরি করছেন। তিনি বলেন,
“আগে অনেক কষ্ট হতো—মাসকলাই ভিজিয়ে পাটায় পিষতে হতো। এখন মেশিনে মাড়াই করাই, তাই কষ্টও কম, সময়ও বাঁচে।”

কুমড়ো বড়ি বিক্রি করেই তিনি সংসার চালিয়েছেন, সন্তানদের পড়াশোনার খরচ জোগিয়েছেন, আর্থিকভাবে দাঁড়িয়ে গেছেন।
“এই কাজের আয় দিয়ে তালগাছী গ্রামে ৯ শতাংশ জমি কিনে বাড়ি করেছি। আল্লাহর কৃপায় স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে এখন সুখেই আছি,” বলেন তিনি।

জাহানারার সাফল্যে উৎসাহিত হচ্ছে এলাকার নারীরা

স্থানীয়রা জানান, একসময় দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা জাহানারা খাতুনের জীবন কুমড়ো বড়ি তৈরি থেকেই বদলে যায়। তার সাফল্য দেখে এখন এলাকার আরও অনেক নারী এই পেশায় যুক্ত হয়েছেন।

ধীরে ধীরে শাহজাদপুরে কুমড়ো বড়ি উৎপাদন একটি স্থায়ী আয়ের উৎসে পরিণত হচ্ছে—আর সেই পরিবর্তনের পথ দেখিয়েছেন জাহানারা খাতুন।