
সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার নওগাঁ ইউনিয়নে অবস্থিত হযরত শাহ্ শরীফ জিন্দানী (রহ.) মাজার চলনবিল অঞ্চলের এক প্রাচীনতম ইসলামী ঐতিহ্য। শত শত বছর ধরে এটি শুধু একটি ধর্মীয় উপাসনালয় নয়, বরং স্থানীয় সমাজ, সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত।
ঐতিহাসিক সূত্র ও স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী, হযরত শাহ্ শরীফ জিন্দানী (রহ.) মূলত বোখারা অন্তর্গত জিন্দান নগরের রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ধর্মচর্চা ও জ্ঞান অন্বেষণে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। ইসলাম প্রচারের মহান উদ্দেশ্যে তিনি ভারতবর্ষে আগমন করেন এবং পরে বাংলার চলনবিল অঞ্চলের নওগাঁ এলাকায় আস্তানা স্থাপন করেন।
১৫২০ খ্রিস্টাব্দের দিকে তিনি তৎকালীন স্থানীয় রাজা ভানুসিংহের শাসনাধীন এলাকায় আগমন করেন। প্রচলিত কাহিনি অনুযায়ী, তিনি এক অলৌকিক শক্তির অধিকারী ছিলেন এবং বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে নওগাঁ এলাকায় প্রবেশ করেন। ইসলাম প্রচারের মাধ্যমে বহু মানুষ তাঁর অনুসারী হন এবং এই অঞ্চল ইসলামী চেতনায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
মাজারের পাশে অবস্থিত প্রাচীন মসজিদটি মধ্যযুগীয় স্থাপত্যশৈলীর অনন্য উদাহরণ।
মসজিদটি একটি বড় গম্বুজবিশিষ্ট স্থাপনা, যার চার প্রান্তে চারটি ছোট গম্বুজ রয়েছে।
বাহিরের দৈর্ঘ্য প্রায় ৫০ ফুট, প্রস্থ ৩৩.৫ ফুট, উচ্চতা ২২.৫ ফুট, আর দেয়ালের পুরুত্ব প্রায় ৯ ফুট।
মূল গম্বুজের উচ্চতা প্রায় ২৬ ফুট।
মসজিদের অভ্যন্তরে হযরত শাহ্ শরীফ জিন্দানী (রহ.) এর পবিত্র কবর অবস্থিত, যা আজও মুসলমানদের জন্য তীর্থস্থলস্বরূপ।
স্থাপনাটির চারপাশে রয়েছে প্রাচীন বৃক্ষ ও শান্ত পরিবেশ, যা দর্শনার্থীদের মনে আধ্যাত্মিক প্রশান্তি জাগায়।
নওগাঁ মাজার শুধু ধর্মীয় স্থান নয়—এটি স্থানীয় মুসলমানদের সামাজিক ঐক্যের প্রতীক।
প্রতি বছর চৈত্র মাসের প্রথম সপ্তাহে তিন দিনব্যাপী বার্ষিক ওরশ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। ওরশ উপলক্ষে দেশের নানা প্রান্ত থেকে হাজারো ধর্মপ্রাণ মানুষ, দরবেশ, আশিক ও সাধক এখানে সমবেত হন।
ওরশের শেষ দিন অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহ্যবাহী ‘বউ মেলা’, যা চলনবিল অঞ্চলের নারীদের অংশগ্রহণে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। এই সময় মাজার প্রাঙ্গণ জুড়ে চলে মিলাদ, কিরাত, দোয়া মাহফিল, মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
মাজারটি সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার নওগাঁ ইউনিয়নে করতোয়া নদীর তীরে অবস্থিত।
তাড়াশ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। স্থানীয় বাস, অটোরিকশা বা ভ্যানযোগে সহজেই পৌঁছানো যায়।
মাজারটি এখনো স্থানীয় মাজার কমিটির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হলেও যথাযথ সরকারি উদ্যোগের অভাবে এর প্রাচীন স্থাপত্য ক্ষয়ের মুখে। স্থানীয় ইতিহাসবিদ ও সংস্কৃতিকর্মীদের মতে, এটি সংরক্ষণ করা গেলে তাড়াশ ও চলনবিল অঞ্চলে ধর্মীয় পর্যটনের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
পরিশেষে,হযরত শাহ্ শরীফ জিন্দানী (রহ.) এর জীবন ও কর্ম ইসলাম প্রচারের মহান উদাহরণ। তাঁর মাজার কেবল একটি ধর্মীয় নিদর্শন নয়, বরং এটি তাড়াশের মানুষের হৃদয়ে আধ্যাত্মিক জাগরণের প্রতীক হয়ে আছে।
স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে এই ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং পর্যটন সুবিধা উন্নয়নের মাধ্যমে সিরাজগঞ্জের ইতিহাস ও সংস্কৃতি আরও সমৃদ্ধ করা সম্ভব।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ লুৎফর রহমান হীরা
হেড অফিসঃ ১/ জি,আদর্শ ছায়ানীড়, রিংরোড, শ্যামলী, আদাবর ঢাকা - ১২০৭।
স্বত্ব © ২০২৫ চলনবিলের সময়