বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত একটি মনোমুগ্ধকর জলাভূমির নাম চলনবিল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষি ও জলজ সম্পদে পরিপূর্ণ এই বিলটি মূলত পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ—এই তিন জেলার বিভিন্ন অংশ নিয়ে গঠিত। ভৌগোলিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বে চলনবিল বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ বিল হিসেবে পরিচিত।
ভৌগোলিক পরিধি ও আয়তন
চলনবিলের বিস্তৃতি প্রায় ৩৬৮ বর্গকিলোমিটার, যা বর্ষাকালে আরও অনেকটা বেড়ে গিয়ে প্রায় ৫০০ বর্গকিলোমিটার ছাড়িয়ে যায়। নাটোরের সিংড়া, গুরুদাসপুর; পাবনার ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর এবং সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, রায়গঞ্জ ও উল্লাপাড়া উপজেলাগুলো এই বিলের আওতাভুক্ত।
জনসংখ্যা ও পেশাভিত্তিক জীবনযাপন
চলনবিল এলাকার জনসংখ্যা আনুমানিক ২০-২৫ লাখ (তিন জেলার বিল সংলগ্ন উপজেলা সমূহ মিলিয়ে)। এখানকার মানুষের প্রধান পেশা কৃষি, মাছ ধরা এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু অংশে ক্ষুদ্র ব্যবসা ও পোশাকশিল্পে শ্রমিক হিসেবেও নিয়োজিত হচ্ছেন।
বর্ষাকালে এই জনপদের অধিকাংশ জায়গা পানিতে ডুবে যায়। তখন যোগাযোগের মাধ্যম হয় নৌকা। আর শুকনো মৌসুমে চাষাবাদের জন্য এই ভূমি আশীর্বাদ স্বরূপ।
ইতিহাস ও ঐতিহ্য
চলনবিলের ইতিহাস বহু পুরনো। প্রাচীনকালে এই অঞ্চল ছিল নদী-নালায় পরিপূর্ণ এবং প্রধানত গঙ্গা-পদ্মা ও যমুনার বিভিন্ন শাখা নদীর তলদেশে গঠিত হয়েছে এই বিলাঞ্চল। বলা হয়ে থাকে, প্রাচীন বাংলার সভ্যতার বিকাশে চলনবিল অঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
এখানে এখনও খোঁজ পাওয়া যায় প্রাচীন পুন্ড্রনগরের ধ্বংসাবশেষ, প্রাচীন হিন্দু ও বৌদ্ধ স্থাপত্য এবং ব্রিটিশ আমলের খাল-বিলের নিদর্শন। লোকসংগীত, পালাগান, ভাটিয়ালি, নৌকা বাইচ ইত্যাদি সংস্কৃতি এখানকার মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
যোগাযোগ ব্যবস্থা
চলনবিল এলাকায় এখনও উন্নত সড়ক যোগাযোগ কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে, তবে গত এক দশকে কিছু উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। নাটোর-বনপাড়া-সিংড়া মহাসড়ক, পাবনা-চাটমোহর রেললাইন এবং তাড়াশ-উল্লাপাড়া সড়কপথ এখন কিছুটা সহজে যোগাযোগের সুযোগ তৈরি করেছে।
বর্ষাকালে অনেক জায়গায় নৌকা এখনো প্রধান বাহন। সরকারিভাবে কিছু এলাকাকে পর্যটন উন্নয়ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সম্ভাবনা
চলনবিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনন্য। বর্ষাকালে বিলের পানিতে যখন আকাশের রূপালি প্রতিচ্ছবি পড়ে, তখন মনে হয় এ যেন এক স্বর্গীয় দৃশ্যপট। হাজারো জাতের জলজ উদ্ভিদ, দেশি মাছ, হাঁসপালন, পাখির কলকাকলি এখানে এক অনন্য পরিবেশ সৃষ্টি করে।
ইকো ট্যুরিজম, মৎস্য চাষ, জৈব কৃষি, লোকজ সংস্কৃতির সংরক্ষণ—এই বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে চলনবিলকে একটি আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন ও অর্থনৈতিক জোন হিসেবে গড়ে তোলার অপার সম্ভাবনা রয়েছে।
সমস্যা ও করণীয়
অভিযোগ রয়েছে, বিলের মধ্যে অবৈধ দখল, জলাশয়ের ভরাট, রাসায়নিক কৃষিকাজ ও অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ বিলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছে। এ ছাড়াও, খাল ও নদীগুলোর নাব্যতা হ্রাস, অপরিকল্পিত সেতু ও রাস্তাঘাট নির্মাণেও জলপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এই এলাকার সুরক্ষায় প্রয়োজন ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা, উন্নয়ন সংরক্ষণ আইন, স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ এবং টেকসই কৃষি ও মাছচাষ প্রণয়ন।
চলনবিল শুধু একটি জলাভূমি নয়, এটি একটি জীবন্ত ইতিহাস, জীবিকার আধার ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অফুরন্ত ভাণ্ডার। সঠিক পরিকল্পনা ও সংরক্ষণমূলক উদ্যোগের মাধ্যমে এটি হতে পারে দেশের একটি অর্থনৈতিক ও পর্যটন হাব।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ লুৎফর রহমান হীরা
ঢাকা অফিস: ১/জি,আদর্শ ছায়ানীড়,রিংরোড,শ্যামলী,আদাবর ঢাকা-১২০৭।
©2025 l চলনবিলের সময়