সাতলার লাল শাপলার বিল: সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে পর্যটকদের ঢল

: বরিশাল প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১ সপ্তাহ আগে

28

বরিশালের উজিরপুর উপজেলার সাতলা ইউনিয়নের উত্তর সাতলা এবং আগৈলঝাড়া উপজেলার বাগধা ও খাজুরিয়া গ্রামের বিস্তীর্ণ জলাভূমি এখন লাল শাপলার অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর। প্রায় ১০ হাজার একর জলাভূমি জুড়ে প্রস্ফুটিত লাল শাপলা যেন প্রকৃতির বুকে রচনা করেছে মনোমুগ্ধকর দৃশ্যপট। সকালবেলা সূর্যের আলোয় ঝলমলে পানির বুকে মাথা তুলে দাঁড়ানো হাজারো শাপলা ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হচ্ছেন স্থানীয় ও দূরদূরান্ত থেকে আগত দর্শনার্থীরা।

প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া এই জলাভূমি স্থানীয়ভাবে পরিচিত ‘সাতলার লাল শাপলার বিল’ নামে। প্রতিবছর জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়জুড়ে শাপলা ফুলে মুখর থাকে পুরো এলাকা। আর এই সময়টাতেই হাজার হাজার পর্যটক ছুটে আসেন লাল শাপলার সৌন্দর্য উপভোগে। ছোট ছোট নৌকায় চড়ে তারা ঘুরে বেড়ান বিলে, তুলে রাখেন সেলফি ও ছবির স্মৃতি।

ভোরের আলোয় রঙিন রূপ

ভোরের আলো পড়তেই সাতলার বিল যেন পরিণত হয় লাল শাপলার লীলাভূমিতে। টলটলে পানির ওপর সবুজ পাতার মাঝে লাল শাপলার সারি—তারই সাথে বক, পানকৌড়ি, মাছরাঙা, ফিঙে, দোয়েল, শালিক, চড়ুইসহ নানা প্রজাতির পাখির কলতানে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো বিল এলাকা। প্রকৃতির এমন মোহনীয় দৃশ্য দেখতে সূর্যোদয়ের পর থেকেই ভিড় জমে পর্যটকদের।

নৌকা ভাড়া ও পর্যটন কর্মকাণ্ড

সাতলার বিলে বর্তমানে প্রায় ১৫টি স্পটে চার শতাধিক ছোট-বড় নৌকা রয়েছে। এসব নৌকায় ঘুরে শাপলার সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতি ঘণ্টায় পর্যটকদের গুনতে হয় ৫০০ থেকে ১,০০০ টাকা পর্যন্ত। স্থানীয়দের মতে, মৌসুমি এ আয় দিয়েই চলছে তাদের সংসার। শুক্র ও শনিবার পর্যটকের ভিড় বেশি থাকলেও অন্যান্য দিনে তেমন ভিড় থাকে না।

নৌকা চালক নজরুল ইসলাম ও দেলোয়ার হোসেন বলেন,শাপলার মৌসুমেই আমাদের আয়ের সময়। ক্ষেত-খামারে কাজ না থাকলে এই বিলই ভরসা। পর্যটকদের ভাড়াই এখন জীবিকার প্রধান উৎস।

 

তবে পর্যটকদের অভিযোগ, আগে অল্প টাকায় ইচ্ছেমতো ঘোরা যেত, এখন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বেশি ভাড়া নিচ্ছে নৌকা চালকরা। এতে পর্যটক সংখ্যা কিছুটা কমছে বলেও অনেকে দাবি করেন।

স্থানীয়দের কর্মসংস্থান

লাল শাপলার বিল শুধু সৌন্দর্যেই নয়, কর্মসংস্থানেও এনেছে পরিবর্তন। সরকারি বা বেসরকারি আবাসন না থাকায় স্থানীয় অনেকে পর্যটকদের কাছে নিজ ঘর ও নৌকা ভাড়া দিয়ে বাড়তি আয়ের সুযোগ তৈরি করেছেন।

দর্শনার্থীদের অভিজ্ঞতা

বরিশালের কলেজছাত্রী মারিয়া বলেন,অনেক দিন ধরে শুনছিলাম সাতলার লাল শাপলার বিলের কথা। আজ সরাসরি দেখে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি। তবে দর্শনার্থীরা ফুল ছিঁড়ে ফেলছেন—এটা বন্ধ হওয়া দরকার।

মাদারীপুর থেকে ঘুরতে আসা নবদম্পতি শাহীন ও তামান্না জানান,রাতভর বাসে ভ্রমণ করে সকালে এসে এই সৌন্দর্য দেখে ক্লান্তি একেবারেই উড়ে গেছে। তবে এখানে যদি হোটেল বা আবাসনের ব্যবস্থা থাকত, তাহলে আরও পর্যটক আসতে পারতেন।

উন্নয়ন পরিকল্পনা

সাতলা ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান শাহীন হাওলাদার বলেন,লাল শাপলার বিল এখন পর্যটনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। আগে রাস্তা-ঘাটের অবস্থা খারাপ থাকায় পর্যটকরা আসতে পারতেন না। এখন সড়ক সংস্কার হওয়ায় যাতায়াত সহজ হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনও এ এলাকা ঘিরে নতুন উন্নয়ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।

সাতলার লাল শাপলার বিল এখন বরিশালের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানে পরিণত হয়েছে। ভোরের আলোয় লাল শাপলার অপরূপ দৃশ্য যেন এক টুকরো জীবন্ত চিত্রকর্ম—যা একবার দেখলে ভুলে থাকা কঠিন। যথাযথ পরিকল্পনা ও সংরক্ষণ উদ্যোগ নিলে এই বিল হতে পারে দেশের অন্যতম প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র।